ছেলেটি সৌদি আরবে একটি ভালো চাকরি করে। দেশে হঠাৎ করে তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটায় তিনি নড়াচড়া ও কাজ করতে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়েন। দেশের তার সুচিকিৎসা সম্ভব নয়।
ডাক্তাররা তার চিকিৎসার অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করানোর পরামর্শ দিলেন। তারা জানিয়ে দিলেন, সেখানে রোগী সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে তিনি কখনোই আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবেন না। তিনি আজীবন শয্যাশয়ী থাকবেন। কখনো নড়াচড়া করতে বা হাঁটতে পারবে না। কখনো কথাও বলতে পারবেন না।
ডাক্তারদের কথা শুনে ছেলেটির পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। তারা চিন্তা করতে লাগলো, বিদেশে চিকিৎসা চলাকালে বাবাকে কে দেখাশোনা করবে ? এত দীর্ঘ সময় কে তার সাথে বিদেশে পড়ে থাকবে? সবারই তো কাজ আছে। সন্তানদের মধ্য থেকে তখন একজন বলে উঠল, ` ভাইয়েরা, চিন্তা করো না। আমি থাকবো বাবার সাথে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বাবা যতদিন জীবিত থাকবেন, আমিই তার দেখাশোনা করব।
বৃদ্ধের চার সন্তানের মধ্যে এই ছেলেটি সবার ছোট। বয়স পঁচিশ থেকে ত্রিশ এর মাঝামাঝি। বিদেশে ভালো একটা চাকরি করতো সে। তাছাড়া, সে বিয়ে পর্যন্ত করেনি তখনো।
তাই তার কথায় অন্য ভাইয়েরা শঙ্কিত হলো যে, বাবার করুণ অবস্থা দেখে আবেগের বশে হয়ত তাদের ছোট ভাইটি এই কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে; কিন্তু সে এই অঙ্গীকার পূরণ করতে পারবে না। তারা ভাবলো, সে তো বিদেশে খুব ভালো পোস্টে চাকরি করে। সে যদি অসুস্থ বাবার সেবা যত্ন করতে যায়, তাহলে তার চাকরির কি হবে? তার সারা জীবনের স্বপ্ন, ক্যারিয়ার, দূর-দূরান্তে বেড়াতে যাওয়ার তার যে শখ-সেগুলোর কি হবে ? বাবার চিকিৎসায় হয়তো বহু বছর লেগে যাবে। সে কি তার যৌবন, আশা-স্বপ্ন সব কিছু উৎসর্গ করতে প্রস্তুত..??
বড় ভাইয়েরা নানা বিষয়ে চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেও, ছোটভাই তাদেরকে বুঝিয়ে রাজি করালো; অতঃপর সে সবকিছু ছেড়েছুড়ে বাবাকে নিয়ে বিদেশে চলে এলো। এই ভিনদেশে অনুগত সন্তানই বাবার একমাত্র অবলম্বন। হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর থেকে সে সাধ্যমত বাবার সেবা যত্ন করেছে। সময় মতো ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে, গোসল করিয়েছে, খাবার খাইয়েছে। বাবা ঘুমানোর পর ছেলেটি বিছানায় পিঠ লাগাত। বাবা ঘুম থেকে উঠার আগে আগেই সে উঠে পড়তো।
একটি সপ্তাহ, একটি মাস বা একটি বছর নয়। দীর্ঘ 13 টি বছর নিরলস বাবার সেবা করে গেছে। বাবার সাথে সে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতো, শ্রদ্ধা করত, ভালোবাসত। কখনো বুঝতে দেয়নি যে, বাবার সেবা করতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এক মুহূর্তের জন্যও ক্লান্তি বা বিরক্তির ছাপ তার মুখে ফুটে ওঠেনি।
বাবাও ছিলেন সন্তানের প্রতি কৃতজ্ঞ; কিন্তু কথা বলতে অক্ষম হওয়ায় তিনি কখনো নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেননি। ভালোবাসার দৃষ্টিতে ছেলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতেন কেবল। এভাবে অসুস্থতায় ভুগতে ভুগতে একদিন তিনি মারা-ই গেলেন।
হাসপাতালে ডাক্তার থেকে নার্স, আয়া থেকে ভুয়া সবাই ছেলেটিকে চিনত। দীর্ঘ 13 বছর ধরে সে বাবার সেবায় আত্মনিয়োগ করে আছে। এই হাসপাতালের ইট-পাথরও সম্ভবত তাকে চেনে; কিন্তু এখন সে মধ্যবয়সী। চল্লিশোর্ধ বয়স তার। কোন চাকরি নেই, স্ত্রীর নেই, সন্তান নেই, নেই কোনো ভবিষ্যৎ। এই দীর্ঘ সময়ে সে নিকটাত্মীয় ও বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তার আত্মত্যাগের কথা কে-ই বা মনে রাখবে?
দুনিয়ায় হয়তো তার এই ত্যাগের স্বীকৃতি দেওয়ার কেউ নেই,; কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহুওয়া তা'য়ালা তো আছেন, তিনি তো ন্যায় বিচারক। তিনি কারও বিন্দু পরিমাণ কর্মফল ও বিনষ্ট করেন না। তিনি অবশ্যই ছেলেটার এই কাজে সন্তুষ্ট। নিশ্চয়ই তিনি তাকে এর উত্তম পুরস্কার দেবেন। আমিন
0 মন্তব্যসমূহ